১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস অলোচনা সভা গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক এর বক্তব্য
— August 16, 2011বঙ্গবন্ধুর সারাজীবনের সাধনা ছিল সাধারণ জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তির মাধ্যমে স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়া। তাইতো আমরা দেখেছি পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি পাকিস্তান গণপরিষদে কৃষকদের পক্ষে জোরালো ভূমিকা গ্রহণ; ষাটের দশকে বাঙালির মুক্তির সনদ ছয়-দফা ঘোষণা, সত্তরের নির্বাচনী কর্মসূচিতে কৃষকসহ সাধারণ মানুষের কল্যাণে অবকাঠামো উন্নয়ন, কৃষি সংস্কার ও সামাজিক ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা, সকলের অংশগ্রহণে অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন এবং সর্বোপরি বাঙালির সার্বিক অর্থনৈতিক মুক্তির দাবীতে সর্বক্ষণ সোচ্চার ছিলেন বঙ্গবন্ধু। বঙ্গবন্ধু গভীরভাবে বিশবাস করতেন, কৃষির উন্নতির ছাড়া এদেশের মানুষের মুক্তি আসতে পারে না। তাইতো সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের কৃষকদের ভাগ্যোন্নয়নে ধ্বংসপ্রাপ্ত কৃষি অবকাঠামো পুননির্মাণ, কৃষি যমত্রপাতি সরবরাহ, ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মওকুফ, কৃষি পণ্যের ন্যূনতম ন্যায্যমূল্য বেঁধে দেওয়া, বকেয়া কৃষি ঋণ মওকুফ, নামমাত্র মূল্যে বীজ সরবরাহ এমনিতর বহুবিধ পদক্ষেপ গ্রহণ করে কৃষি ক্ষেত্রে উৎপাদনশীলতা ও উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে খাদ্যে স্বনির্ভরতা অর্জনের চেষ্টা করেছিলেন।
কৃষক সমাজ তথা এদেশের সাধারণ মানুষের জন্যে তাঁর অগাধ ভালোবাসা এবং সোনার বাংলা গড়ার লক্ষ্যে তাঁর সুবিস্তৃত পরিকল্পনার কিছু অংশ নিম্নে উদ্ধৃত করা হলো ঃ
—‘আমাদের চাষীরা হলো সবচেয়ে দুঃখী ও নির্যাতিত শ্রেণী এবং তাদের অবস্থার উন্নতির জন্যে আমাদের উদ্যোগের বিরাট অংশ অবশ্যই তাদের পিছনে নিয়োজিত করতে হবে‘। (-বঙ্গবন্ধুর বেতার ও টেলিভিশনে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ, ২৬ মার্চ, ১৯৭২)
—‘কৃষি ব্যবস্থাকে অবশ্যই আধুনিকীকরণ করতে হবে। অবিলম্বে চাষীদের বহুমুখী সমবায়ের মাধ্যমে ভূমি–সংহতিসাধনে উদ্বুদ্ধ করতে হবে‘। (-বঙ্গবন্ধুর বেতার ও টেলিভিশনে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ, ২৮ অক্টোবর, ১৯৭০)
—‘প্রাকৃতিক সম্পদের সর্বাধিক উন্নয়নের জন্যে বৈজ্ঞানিক তৎপরতা চালাতে হবে। অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে আমাদের বনজ সম্পদ, ফলের চাষ, গো–সম্পদ, হাঁস–মুরগির চাষ – সর্বোপরি মৎস্যচাষের ব্যবস্থা করতে হবে‘। (-বঙ্গবন্ধুর বেতার ও টেলিভিশনে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ, ২৮ অক্টোবর, ১৯৭০)
—জমির উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্যে তিনি বলেছেন, ‘আমার জমি দুনিয়ার সেরা জমি। আমি কেন সে জমিতে ডবল ফসল করতে পারবো না। দ্বিগুণ করতে পারবো না। যদি দ্বিগুণ করতে পারি তাহলে আমাকে খাদ্য কিনতে হবে না‘। (-১৯৭৫ সালের ২৬ শে মার্চ দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি ঘোষণাকালে )
— তিনি আরো বলেছেন, ‘আমরা বাংলাদেশের মানুষ, আমাদের মাটি আছে, আমার সোনার বাংলা আছে, আমার পাট আছে, আমার গ্যাস আছে, আমার চা আছে, আমার ফরেস্ট আছে, আমার মাছ আছে, আমার লাইভস্টক আছে। যদি ডেভেলপ করতে পারি ইনশাল্লাহ এ দিন থাকবে না‘। (-১৯৭৫ সালের ২৬ শে মার্চ দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি ঘোষণাকালে )
—ক্ষুদ্রায়তন ও কুটির শিল্পকে ব্যাপকভাবে সমর্থন করে তিনি বলেন, ‘গ্রামে গ্রামে সব শিল্পকে এমনভাবে ছড়িয়ে দিতে হবে, যার ফলে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে বিভিন্ন প্রকার শিল্প সুযোগ পৌঁছায় এবং গ্রামীণ মানুষের জন্যে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়‘।
–বঙ্গবন্ধুর আজন্ম স্বপ্ন ছিল মাটি ও মানুষ ঘনিষ্ঠ অর্থনীতি গড়ে তোলা। তাইতো তিনি বলতেন, ‘আমার মাটির সাথে, আমার মানুষের সাথে, আমার কালচারের সাথে, আমার ব্যাকগ্রাউন্ডের সাথে, আমার ইতিহাসের সাথে যুক্ত করেই আমার ইকোনমিক সিস্টেম গড়তে হবে‘।
বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ে তোলার প্রয়াসে বর্তমান সরকার সূচিত উন্নয়ন রূপকল্প বাস্তবায়নে দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংক আর্থিক খাতের স্থিতিশীলতা রক্ষা, উচ্চ প্রবৃদ্ধি সহায়ক আর্থিক অন্তর্ভুক্তিকরণ কর্মসূচি বাস্তবায়ন, আর্থিক ব্যবস্থায় যুগান্তকারী পরিবর্তন সাধনকল্পে প্রযুক্তিনির্ভর ব্যাংকিং সেবার প্রচলনে নিরন্তর কাজ করে যাচ্ছে। Digital Bangladesh বিনির্মাণে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত তার সবের্বাচ্চ অবদান যাতে রাখতে পারে বাংলাদেশ ব্যাংক তা নিশ্চিত করতে সর্বক্ষণ তৎপর রয়েছে। এ কাজের অংশ হিসেবে এরই মধ্যে আমরা বঙ্গবন্ধুর আত্মার আত্মীয় এদেশের কৃষক, ক্ষুদে উদ্যোক্তা, নারী উদ্যোক্তাসহ বিরাট সংখ্যক সৃজনশীল উদ্যোক্তা শ্রেণীর ভাগ্যোন্নয়নে সরকারের নানামুখী উদ্যোগের সহযাত্রী হিসেবে ব্যাংকিং খাতকে গতিশীল রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছি।
বঙ্গবন্ধুর এই গরীব হিতৈষী স্বদেশী উন্নয়ন ভাবনা সাম্প্রতিক বৈশিবক মন্দা মোকাবিলায় প্রধানতম হাতিয়ার হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে সারা বিশেব। নিশ্চয় আমরা গর্ব করতে পারি তাঁর স্বদেশী উন্নয়ন ভাবনা নিয়ে।
সাম্প্রতিক সময়ে কৃষিকে আমাদের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি বিবেচনায় বাংলাদেশ ব্যাংক, কৃষি ঋণের পরিমাণগত ও গুণগত ব্যাপক পরিবর্তন এনেছে। গত বছর আমাদের ব্যাংকিং খাতের নিরলস প্রচেষ্টার ফলে এ যাবতকালের মধ্যে সর্বোচ্চ ১২,১৮৪ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করা সম্ভব হয়েছে যা নির্দ্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার ৯৭ শতাংশ। বর্গাচাষিদের প্রাতিষ্ঠানিক ঋণ প্রাপ্তি নিশ্চিতকরণের জন্যে প্রথমবারের মতো ৫০০ কোটি টাকার একটি পুনঃঅর্থায়ন স্কীম চালু করা হয়েছে। উক্ত স্কীম এবং বার্ষিক কৃষি ঋণ কর্মসূচির আওতায় মোট ৬,৬১,০০০ জন বর্গাচাষিকে প্রায় ১০১০ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করা হয়েছে। এছাড়া, আমদানি বিকল্প ফসল চাষের জন্যে কৃষকগণকে ২ শতাংশ রেয়াতী সুদহারে ঋণ বিতরণ করা হচ্ছে।
গত অর্থবছরে ৩,৩২,০০০ হাজার নারীকে ৭২৫ কোটি টাকা কৃষি ঋণ বিতরণ করা হয়েছে। বর্তমান অর্থবছরের জন্যে ১৩,৮০০ কোটি টাকা কৃষি ঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে এবং এ লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়নে ইতোমধ্যে কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। এছাড়া, সরকার প্রদত্ত বিভিন্ন ভর্তুকী ব্যাংকের মাধ্যমে সহজে প্রাপ্তির জন্যে মাত্র ১০ টাকা জমা দিয়ে এ পর্যন্ত প্রায় ৯৫ লক্ষ কৃষক ব্যাংকে গিয়ে তাদের একাউন্ট খুলেছেন। কৃষির বহুমুখীকরণ, নতুন নতুন খাত ও ফসল অন্তর্ভুক্তকরণ, কৃষি ঋণ বিতরণে স্বচ্ছতা আনয়নের জন্যে প্রকাশ্যে ঋণ বিতরণের ব্যবস্থা প্রবর্তন, কৃষকের একাউন্টের মাধ্যমে ঋণ বিতরণ, ঋণ বিতরণে স্বচ্ছতা আনয়নের জন্যে মোবাইল ও তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহারসহ সামগ্রিকভাবে মনিটরিং ব্যবস্থা শক্তিশালীকরণের মাধ্যমে কৃষি ঋণ বিতরণ ব্যবস্থাকে টেকসই করার পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। এ কাজে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের অবদানও কম নয়। তারা ঋণ বিতরণে অনেক নতুনত্ব ও স্বচ্ছতা আনতে সক্ষম হয়েছে। প্রকাশ্যে ঋণ বিতরণ, ঋণ বিতরণে নাগরিক অডিট পদ্ধতি এর ব্যবস্থা করা, ঋণ আদায়েও অধিকতর মনোযোগী হবার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।
বঙ্গবন্ধুর আরাধ্য অর্থনৈতিক মুক্তির অংশ হিসেবে বাংলাদেশের কৃষকদের ভাগ্যোন্নয়নে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের সাম্প্রতিক সময়ে এই যে ঘুরে দাঁড়ানো- তার জন্যে এই ব্যাংকের সকল নির্বাহীকে আন্তরিক অভিনন্দন জানাচ্ছি।
অপরদিকে, মৎস, পোলট্রি, বায়োগ্যাসসহ নানা খাতের ক্ষুদে উদ্যোক্তাদের জন্যেও ঋণ বিতরণে অনুরূপ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।
এ সমস্ত পদক্ষেপের ফল সুদূরপ্রসারী হতে বাধ্য। একই সঙ্গে ব্যক্তিখাতের ও সরকারী ব্যাংকগুলোকে গ্রামে আরো বেশি শাখা খোলার জন্যে উৎসাহী করে যাচ্ছি। প্রযুক্তি নির্ভর মোবাইল ব্যাংকের প্রসার ঘটিয়ে বঙ্গবন্ধুর প্রিয়জন সাধারণ মানুষকে বেশি করে ব্যাংকিং সেবার সুযোগ সৃষ্টি করছি।
১৮ জানুয়ারী ১৯৭৪ সনে আওয়ামী লীগের দ্বি-বার্ষিক কাউন্সিলে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমি যদি বাংলার মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে না পারি, আমি যদি দেখি বাংলার মানুষ দুঃখী, আর যদি দেখি বাংলার মানুষ পেট ভরে খায় নাই তাহলে আমি শান্তিতে মরতে পারব না– পারব না– পারব না‘। কী নিবিড় ছিল তাঁর জনগণের জন্যে ভালোবাসা। বঙ্গবন্ধুর সে ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে কৃষি ও কৃষকের উন্নতি, ক্ষুদে উদ্যোক্তাদের উন্নতি, নারী উদ্যোক্তাদের উন্নতি এমনিকরে সমাজের প্রতিটি পরতে পরতে আমরা উন্নয়নের ছোঁয়া পৌঁছে দিতে চাই। আর এর মাধ্যমেই জাতির পিতার কাছে আমাদের আরাধ্য ঋণ পরিশোধ করতে চাই। আর এ কাজে আপনাদের সবাইকে নিবিড় সঙ্গী হিসেবে পেতে চাই। সংবাদ বিজ্ঞপ্তি