Plastic pollution: A serious threat to environment
— April 30, 2022Md. Arafat Raahman:Plastic pollution is the extraction of plastics by the environment which in turn has adverse effects on wildlife,…
নেত্রকোনা থেকে অহিদুর রহমান
১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধ শেষ হয়েছে। একজন মুক্তিযোদ্ধার যুদ্ধ থামে নাই। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করার জন্য মুক্তিযোদ্ধের গল্পের মাধ্যমে শুরু করেন এ যুদ্ধ। স্ট্যান্ডে সাদা বোর্ড, হাতে মার্কারি কলম, উত্তর-দক্ষিণ-পূর্ব-পশ্চিম চিহ্নিত করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আর মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান দেখাচ্ছেন এই যোদ্ধা। গল্পের মতো করে দর্শকশ্রোতাদের বুঝিয়ে দিচ্ছেন যুদ্ধের ঘটনা। বোর্ড ব্যবহার করে মুক্তিযুদ্ধের গল্প বলার এ দৃশ্য প্রতি শুক্রবার চোখে পড়ে ময়মনসিংহ শহরের পৌর পার্কে এবং সময় করে ময়মনসিংহ ও নেত্রকোনার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের মাঝে সচিত্র বুঝিয়ে দিচ্ছেন আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মকে। তিনিই আমাদের মুক্তিযোদ্ধের গল্পের ফেরিওয়ালা বিমল পাল।
ময়মনসিংহের বলাশপুর মুক্তিযোদ্ধা পল্লীতে বিমল পালের বাসা। থানার ঘাট এলাকায় তাঁর ছোটখাটো একটি মনিহারি দোকান আছে, চা বিক্রি করেন সেই দোকানে। বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রমেও তিনি সক্রিয়। এ শহরের সাধারণ মানুষ থেকে বিশিষ্টজনদের অনেকেই তাঁকে এক নামে চেনেন। ১৯৭১ সালের বীর মুক্তিযোদ্ধা বিমল পাল জীবন সায়াহ্নে এসে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাসকে আগামী প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে চান। সে লক্ষ্যে সময়-সুযোগ পেলেই তিনি ছুটে যান ময়মনসিংহের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র-ছাত্রীর কাছে। এভাবেই তিনি নিজেকে করে তুলেছেন মুক্তিযুদ্ধের গল্প বলার ফেরিওয়ালা হিসেবে। আগামীতে তিনি সারা দেশে তার সংগৃহীত অসংখ্য মাঠ পর্যায়ের যুদ্ধের ইতিহাস তুলে ধরতে চান। তিনি গত দু’বছরে শতাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ও উন্মুক্ত স্থানে ২০০ বেশি আসর করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের গল্প বলেছেন। বীর মুক্তিযোদ্ধা বিমল পাল জানান, তার সঙ্গে হোয়াইট বোর্ড, মার্কার পেন সব সময় থাকে। স্কুল অথবা কলেজ প্রধানের সঙ্গে কথা বলে তিনি মুক্তিযুদ্ধের ওপর একটি ক্লাস নিতে অনুমতি চান। অনুমতি মিললেই তিনি শুরু করেন মুক্তিযুদ্ধের গল্প বলা।
তিনি বলা শুরু করেন এভাবে, “এখন যেই দেশে স্বাধীনভাবে চলাফেরা করছ, স্বাধীনভাবে লেখাপড়া করছ, মুক্তভাবে চিন্তা করার সুযোগ পাচ্ছ, ’৭১ সালের পূর্বে আমরা যখন পাকিস্তানিদের অংশ হয়ে যে দেশটিতে বসবাস করতাম, তার নাম ছিল পূর্ব পাকিস্তান। ’৪৭ থেকে ’৭১ পর্যন্ত আমরা ছিলাম মূল পাকিস্তান থেকে ১২০০ মাইল পূর্বে, বর্তমান ভূখন্ডে। পকিস্তানে সামরিক শাসন উপনিবেশিক শাসন-শোষণ এবং ধর্মভিত্তিক সমাজব্যবস্থা এখানে জোর করে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। ফলে হাজার বছরের সরলপ্রাণ বাঙালি, ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর হাতে শোষণের যাঁতাকলে নিস্পেষিত হতে থাকে। একুশের চেতনায় ঘুরে দাঁড়ায় বাঙালি। সেই বাঙালি ’৭০-এর নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে যখন ক্ষমতায় যেতে পারছিল না, তখনই শুরু হয় আমাদের মুক্তিযুদ্ধ।”
মুক্তিযোদ্ধা বিমল পাল ছোট করে, সেই প্রেক্ষাপটের বর্ণনা দেন স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী তথা আগামী প্রজন্মে কাছে। তারপর শুরু করেন মাঠ পর্যায়ের যুদ্ধের বর্ণনা। তার ঝোলায় অসংখ্য গল্প। খাগডহর, মদন, আটপাড়া, নাজিরপুর, কামালপুর, নকসি, তেলিখালি, ঈশ্বরগঞ্জ, ভাওয়ালিয়া বাজু, লক্ষ্মীপুর, মুক্তাগাছা, বোররচর, পলাশ কান্দাসহ আরো অনেক মুক্তিযুদ্ধের গল্প আছে তার ঝোলায়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের কাছে যুদ্ধটির স্থান, যুদ্ধের গুরুত্ব দিয়ে তিনি তুলে ধরেন আঞ্চলিক যুদ্ধের ইতিহাস।
পরিশেষে তিনি আশা করেন, জেলা প্রশাসক, জেলা শিক্ষা অফিসারের মাধ্যমে এবং জেলা তথ্য দপ্তরের সহায়তায় তার সংগৃহীত ভিডিওচিত্র প্রদর্শনীর মাধ্যমে আরো প্রাণবন্ত করে সবার সামনে তা তুলে ধরতে চান। সেখানে থাকবে স্বাধীনতার কবিতা, গান, আবৃত্তি, আর তার গল্প। তখনই ফুটে উঠবে সরকারি উদ্যোগে গল্প বলার ভিন্নমাত্রা। এভাবেই যদি সারা দেশে সরকারি উদ্যোগে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী যোদ্ধাকে দিয়ে গল্প বলার সঠিক ইতিহাস তুলে ধরা যায়, তাহলেই আগামী প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সম্পর্কে সচেতন হবে। এভাবেই তারা একদিন পৌঁছে যাবে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের এই নতুন বাঁকে। দেশপ্রেমে উদ্বূদ্ধ হবে।
বিমল পাল বলেন, “একজন মুক্তিযোদ্ধার কোনো অবসর নেই। চায়ের স্টলে, আড্ডার ছলে, তিনি যে যুদ্ধের কথাটি সব সময় বলেন, সেই কথাগুলো এভাবে স্কুল-কলেজে বলা উচিত। সবার মতো আমিও ১০ হাজার টাকা সম্মানী ভাতা পাই। আমি বর্তমান সরকারের প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া সরকারি ভাতার সম্মানকে এইভাবেই স্কুল-কলেজে মুক্তমাঠে গল্প বলে অক্ষুন্ন রাখতে চাই।
কেমন করে এই ভাবনা এলো, জানতে চাইলে তিনি বলেন, “২০০৭ সালে চ্যানেল আই মুক্তিযুদ্ধ প্রতিদিন নামে একটি অনুষ্ঠান করে। ওই অনুষ্ঠানের উপস্থাপক মুক্তিযোদ্ধা নাসিরউদ্দিন ইউসুফ ভাইয়ের কাছ থেকে একটা কল পেলাম। বললেন, আপনি তো তেলিখালী যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। স্থানীয় বিভিন্ন পত্রিকায় এ যুদ্ধের কাহিনী লিখেছেন। আপনি কি একবার আমাদের স্টুডিওতে এসে এ যুদ্ধের ঘটনাটি বলে যাবেন? খুশি হয়ে জানতে চাইলাম, কবে আসব? বললেন, তেলিখালী যুদ্ধের একটি নকশা এঁকে আমাদের কাছে পাঠান। এরপর সে যুদ্ধের একটি নকশা এঁকে পাঠাই। সেটি অনুমোদন করেন। পরে আমি ঢাকায় চ্যানেল আই কার্যালয়ে গিয়ে কথা বলি।”
সেই অনুষ্ঠানে গিয়েই তাঁর মনে হয়েছিল স্টুডিওতে যেভাবে বললেন, এভাবে যদি বিভিন্ন স্কুল, কলেজ এবং তরুণদের জমায়েতে বলতে পারতেন, তাহলে অনেক ভালো হতো। নতুন প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে জানতে পারত। বিশেষ করে যদি বোর্ডে রেখাচিত্রের মাধ্যমে যুদ্ধক্ষেত্রের বর্ণনা দিয়ে কথা বলা যায়, তাহলে শ্রোতারা মন দিয়ে শুনবে, বুঝতেও সুবিধা হবে। তখনই সিদ্ধান্ত নিলেন, সময়-সুযোগ পেলে কলম আর বোর্ড নিয়ে বেরিয়ে পড়বেন। তিনি বললেন, “আমার কাছে ২ ফুট বাই ৩ ফুট একটা সাদা বোর্ড ছিল। মুক্তিযোদ্ধাভাতা থেকে ৬০০ টাকা দিয়ে তৈরি করি। কোনো জমায়েতে সেই বোর্ডে আমি রেখাচিত্র আঁকি। রেখাচিত্রের মাধ্যমে বিভিন্ন যুদ্ধের দৃশ্যপট, শত্রু ও মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান চিহ্নিত করি।”
এই কার্যক্রমের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু ২০১৪ সালের ৯ জুন ময়মনসিংহ শহরের বিপিন পার্কে। তখন তাঁর সঙ্গী ছিল মোমেন নামের এক কিশোর। বিপিন পার্কে এমন আয়োজনে সহযোগিতার হাত বাড়ায় ‘চেতনা সংসদ’। তারা একটি মাইক ও ব্যানারের ব্যবস্থা করে। উদ্বোধন করেন পৌর মেয়র ইকরামুল হক। পার্কের খোলামেলা পরিবেশে উদ্বোধন হয়। বিমল পাল মেয়রের কাছে অনুরোধ করেন, তিনি যেন প্রতি শুক্র ও শনিবার বিপিন পার্ক এবং শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন পার্কে কাজটি করতে পারেন। পৌর মেয়র সঙ্গে সঙ্গে অনুমোদন দেন এবং সহযোগিতার আশ্বাস দেন।
তিনি বলেন, “এর মধ্যে অনেক সময় মজার ঘটনাও ঘটে, অনেক মানুষ জানতে চায়, সরকার আমাকে এর জন্য টাকা দেয় কি না। আমি তখন বলি, হ্যাঁ, সরকার আমাকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ১০ হাজার টাকা সম্মানী ভাতা দেয়। আর আমি নিজে থেকেই এটা করি, তখন ওরা বিস্মিত হয়।”
তেলিখালীসহ বেশ কয়েকটি জায়গায় যুদ্ধ করেছেন বিমল পাল। তেলিখালীর যুদ্ধ নিয়ে তিনি বের করেছেন ছোট একটি বই। ২০১৮ সালে তিনি ছোটদের মুক্তিযোদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর গল্প নামে একটি শিশুতোষ বই লিখেছেন। তিনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বইগুলো শিক্ষার্থীদেরকে দিয়ে দেন তারপর একটি বইয়ের উপর শুরু হয় কুইজ প্রতিযোগিতা এবং ছোটদের জন্য থাকে পুরস্কার। তিনি ময়মনসিংহ ও নেত্রকোনার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সাথে কাজ করে যাচ্ছেন। তিনি আটপাড়া সিটিপাইলট, মদনপুরের মফিলা ফয়েজ উচ্চ বিদ্যালয়, কাইলাটি উচ্চবিদ্যালয় পাহাড়পুর উচ্চবিদ্যালয়ে ইতোমধ্যে কাজটি শুরু করেছেন।
বিমল পালেরা বেঁচে থাকুক আরো যুব যুগ আমাদের প্রয়োজনে। দেশের প্রয়োজনে।